জুলাইয়ের উষ্ণ রাত। নিজের আরামচেয়ারে কখন যেন আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ করে জেগে উঠলেন! ঠিক বুঝতে পারলেন না যে আপনি কোথায় আছেন! টেলিভিশন চলছে, কিন্তু কোনো শব্দ আসছে না। কী দেখছেন, বুঝতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। পিচকালো আকাশ! আগাগোড়া সাদা কাপড়ে ঢাকা আর মাথায় হেলমেট দেয়া ভূতের মত দুটো শরীর ঢিমতালে নেচে বেড়াচ্ছে। পাতলা বালির আস্তরের ওপরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে লাফাচ্ছে। কিন্তু কী যেন একটা ঠিক মিলছে না! লাফানোর পর নামতে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু দেরি হচ্ছে। ওদেরকে দেখে বেশ ভারী মনে হচ্ছে, কিন্তু তারপরেও মনে হচ্ছে, ওরা যেন উড়ছে—একটু একটু। চোখ কচলে আবার তাকালেন, কিন্তু দৃশ্যটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো না।
১৯৬৯ সালের জুলাইয়ের ২০ তারিখে, অ্যাপোলো ১১ যখন চাঁদে অবতরণ করলো, তখন এটা নিয়ে অনেক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিলো। কিন্তু আমার মনে সবচেয়ে গভীরভাবে গেঁথে আছে এই দৃশ্যটা, দৃশ্যের অতিপ্রাকৃত চরিত্রটা। এটা সত্যি যে চাঁদে অবতরণের ঘটনাটা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের উদাহরণ ছিলো, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিজয়ের চরম উদাহরণ ছিলো। এটাও সত্যি যে, নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং, বায অলড্রিন, আর মাইক কলিন্স মৃত্যুভয়কে জয় করে এই বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। আর (চাঁদে) অবতরণের পরপরই আর্মস্ট্রং যা বলেছেন, সেটাও সত্যি, এটা মানবজাতির জন্য ঐতিহাসিক একটা পদক্ষেপ। কিন্তু আপনি যদি অভিযান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ আর নভোচারীদের মধ্যে নিয়মমাফিক কথাবার্তার শব্দগুলো বন্ধ করে দেন, আর টেলিভিশনের সাদা-কালো দৃশ্যটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন, তাহলে আরেকটা জিনিস উপলব্ধি করতে পারবেন—আমরা প্রবেশ করেছি রূপকথা আর পুরাণের জগতে।
মানবপ্রজাতির শুরু থেকেই আমরা চাঁদকে দেখে আসছি। আমাদের পূর্বসূরীরা যখন আফ্রিকায় গাছ থেকে বৃক্ষহীন তৃণভূমিতে (সাভানা-তে) নেমে এসেছিলো, চাঁদটা তখনো ছিলো। যখন আমরা সোজা হয়ে হাঁটা শিখলাম, যখন প্রথমবারের মত পাথরকে হাতিয়ার বা যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শিখলাম, যখন আগুনকে বশীভূত করলাম, যখন চাষবাস শুরু করলাম, শহর স্থাপন করলাম, পৃথিবীটাকে নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে এলাম—চাঁদটা তখনো ছিলো, পুরো সময়টাই। রূপকথার গল্পে আর গানে চাঁদের সাথে ভালোবাসার একটা সম্পর্ক টানা হয়। যখন আমরা গৃহহীন জীবনযাপন করতাম, যখন চাঁদের উপস্থিতি আমাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো; যদিও আমরা ঠিক বুঝতাম না যে জিনিসটা আসলে কী!
ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, এমন জিনিসের উদাহরণ হিসেবে চাঁদের নাম আসতো। “তুমি বামন হয়ে চাঁদের পানে হাত বাড়াইও না”—এমন বলে কেউ কেউ। মানবপ্রজাতির ইতিহাসের প্রায় পুরো সময়টাই আমরা জানতাম না, চাঁদের প্রকৃত পরিচয়টা আসলে কী। প্রেতাত্মা? দেবতা? মামুলি কিছু? এটাকে দেখতে অনেক দূরের কোনো বিশাল জিনিস মনে হয়নি। মনে হয়েছে, এই আশেপাশেই ছোটো কিছু হতে পারে। হয়তো থালার মত সাইজের কিছু একটা, মাথার খানিকটা ওপরেই ঝুলছে। চাঁদে হাঁটাহাঁটি করার ধারণাটা হয়তো খুব জনপ্রিয় ছিলো না। এর চেয়ে বরং সিঁড়ি ভেঙে অথবা বিশাল কোনো পাখিতে চড়ে চাঁদটাকে পকেটে পুরে নিয়ে আসার ধারণাটা আরো যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিলো অনেকের কাছে। কেউ পারেনি অবশ্য; কিন্তু চেষ্টা করেছে, এমন নায়কদেরকে নিয়ে গল্প আছে প্রচুর।
মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে, চাঁদকে আড়াই লাখ মাইল দূরের একটা জগত হিসেবে দেখার ধারণাটা হালে পানি পেয়েছে। আর এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমরা ওর প্রকৃত পরিচয় জানা থেকে শুরু করে ওর ওপর হাঁটাহাটি করার কাজটাও সেরে ফেলেছি। এর মধ্যেই আমরা হিসেব করেছি কীভাবে মহাশূন্যে কোনো বস্তু চলাফেরা করে; বায়ু থেকে তরল অক্সিজেন বানিয়েছি; উদ্ভাবন করেছি বিশাল সব রকেট, দূর পাল্লার যোগাযোগ ব্যবস্থা, নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি, এবং আরো অনেক কিছু। এরপর পাল তুলে দিয়েছি মহাশূন্যের সাগরে।
চাঁদ এখন আর ধরাছোঁয়ার বাইরের কোনো বস্তু নয়। এক ডজন মানুষ (সবাই আমেরিকান) চাঁদের মর্মর, গর্তযুক্ত, প্রাচীন ছাইরঙা লাভার ওপরে হেঁটেছে—এই যাত্রা আমরা শুরু করেছি ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ের সেই দিনটিতে। কিন্তু ১৯৭২ সালের পর থেকে, কোনো দেশের কেউই আর সেখানে গেল না। সত্যি বলতে, অ্যাপোলোর সেই মহিমাময় দিনগুলোর পর, আমাদের কেউ আর কোনো জায়গাতেই যায়নি। হুম, পৃথিবীর কক্ষপথে গেছে অবশ্য! নতুন হাঁটতে শেখা বাচ্চারা যেমন কয়েক পা এগিয়ে যায়, এরপর জলদি করে মায়ের আঁচলে ফিরে যায়, অনেকটা তেমন!
একসময় আমরা সৌরজগতের সবদিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কয়েক বছর এমন চললো। কিন্তু এরপর আমরা সব গুটিয়ে বসে পড়লাম। কেন? কী এমন হয়ে গেলো? অ্যাপোলোর আসল উদ্দেশ্য কী ছিলো তাহলে?
১৯৬১ সালের ২৫শে মে, কংগ্রেসের যৌথ সভায় “জরুরি জাতীয় প্রয়োজন”-এর জন্য জন কেনেডি যে বক্তৃতাটা দিয়েছিলেন, সেটার ব্যাপ্তি আর ঔদ্ধত্য আমাকে অবাক করেছিলো। আমরা নাকি এমন রকেট তৈরি করবো, যেটার নকশা এখনো আমাদের কাছে নেই; এমন ধাতু (সংকর) ব্যবহার করবো, যেটা এখনো বানাইনি; মহাকাশযানের দিক নির্দেশনা আর নোঙর করার জন্য এমন সিস্টেম তৈরি করবো, যেগুলোর ব্যাপারে কোনো ধারণাই আমাদের নেই; এবং এগুলো ব্যবহার করে অজানা এক জগতে আমাদের একজনকে পাঠাবো। এমন এক জগত যা এখনো অনাবিষ্কৃত, যেখানে কোনো রোবোটও এখনো পাঠানো হয়নি, সেখানে নাকি একজনকে পাঠাবো, এমনকি তাকে নিরাপদে ফিরিয়েও আনবো, তাও আবার এই দশকের মধ্যেই! এই ঘোষণাটা যখন দেয়া হয়েছিলো, তখনো কোনো আমেরিকান পৃথিবীর কক্ষপথেও যায়নি।
তখন আমি সদ্য পিএইচডি অর্জন করেছি! আমার মনে হচ্ছিলো, এই ঘোষণাটা হয়তো বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্দেশ্যে দেয়া। কিন্তু প্রেসিডেন্ট কেনেডি চাঁদের উৎপত্তি রহস্য আবিষ্কার করা নিয়ে কিছু বললেন না, এমনকি চাঁদ থেকে নমুনা নিয়ে এসে গবেষণা করা নিয়েও কিছু বললেন না। ওনার সকল আগ্রহ কেবল ওখানে কাউকে পাঠানো আর ফিরিয়ে আনা নিয়ে। এটা একটা ইঙ্গিত ছিলো। কেনেডির বিজ্ঞান-উপদেষ্টা জেরোম ওয়াইজনার পরে আমাকে বলেছিলেন যে, কেনেডির সাথে ওনার একটা চুক্তি হয়েছিলো—যদি কেনেডি অ্যাপোলো অভিযানকে বিজ্ঞানের সাথে না জড়ান, তাহলে উনি (ওয়াইজনার) সেটাকে সমর্থন দেবেন। তো, বিজ্ঞান যদি উদ্দেশ্য না হয়, তাহলে উদ্দেশ্যটা কী?
আমাকে অন্যরা বললো, অ্যাপোলোর মূল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি মহাকাশের দৌড়ে এগিয়ে থাকে, যদি আমেরিকা যথেষ্ট “জাতীয়তাবাদী সাহস” না দেখায়, তাহলে অন্যান্য দেশগুলো নাকি সোভিয়েতের দিকে ঝুঁকে পড়বে। আমি ঠিক বুঝলাম না। আমেরিকা তো বলতে গেলে প্রযুক্তির প্রায় সকল দিক থেকেই সোভিয়েতের চেয়ে এগিয়ে; অর্থনৈতিক, সামরিক, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে নৈতিক দিক থেকেও! অথচ জন গ্লেনের আগে ইউরি গ্যাগারিন পৃথিবীর কক্ষপথে গেলো বলে ইন্দোনেশিয়া কমিউনিস্ট হয়ে যাবে? মহাকাশ প্রযুক্তি এত জরুরি কেন? হঠাৎ করেই ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম।
পৃথিবীর কক্ষপথে মানুষ পাঠানোর জন্য অথবা সূর্যের কক্ষপথে রোবোট পাঠানোর জন্য রকেটের দরকার! বিশাল, নির্ভরযোগ্য, শক্তিশালী সব রকেট! সেই একই রকেটকে পারমাণবিক যুদ্ধের জন্যেও ব্যবহার করা যায়। যে প্রযুক্তি মানুষকে চাঁদে নিয়ে যাবে, সেই একই প্রযুক্তি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডও নিয়ে যেতে পারে। যে প্রযুক্তি মানুষ আর দূরবীক্ষণ যন্ত্রকে পৃথিবীর কক্ষপথে বসাতে পারে, একই প্রযুক্তি লেজার যুদ্ধের জন্য আস্তানাও গড়তে পারে।
তখনো পূর্ব-পশ্চিম উভয় সামরিক মহলেই মহাকাশ নিয়ে বেশ আড্ডা জমতো। আড্ডার বিষয়—মহাকাশ হচ্ছে নতুন ঘাঁটি; যে জাতি মহাকাশ নিয়ন্ত্রণ করবে, তারাই গোটা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করবে। অবশ্য ততদিনে সামরিক উদ্দেশ্যে বেশ কিছু রকেট পরীক্ষা করা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝামাঝি কোনো একটা জায়গাকে নিশানা করে, ভুয়া ওয়ারহেড লাগিয়ে মিসাইল ছুঁড়লে বিশ্বের দরবারে তেমন পাত্তা পাওয়া যায় না। মানুষকে মহাশূন্যে পাঠালে অবশ্য গোটা বিশ্বের চোখে তাক লাগিয়ে দেয়া যায়। অবশ্য, শুধু এই কারণে এত টাকা খরচ করে নভোচারীদেরকে মহাশূন্যে পাঠানো হয় না। আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে নিজেদের রকেটের শক্তি দেখানো! অনেকটা জাতীয় পুরুষাঙ্গ নিয়ে বড়াই করার মত; সহায়ক (বুস্টার) রকেটগুলোর আকৃতি দেখলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়, কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। এই অনুভূতিটা মনে হয় এক অচেতন মন থেকে আরেক অচেতন মনে বয়ে গেছে; মস্তিষ্কের সচেতন অংশগুলো বুঝতেও পারেনি যে আসলে কী ঘটছে।
যখন প্রেসিডেন্ট কেনেডি অ্যাপোলো প্রোগ্রামের ঘোষণা দিলেন, তখন প্রতিরক্ষা বিভাগের কাছে মহাকাশ নিয়ে আরো অনেকগুলো পরিকল্পনা ছিলো, যেমন—কিভাবে সামরিক লোকজনদেরকে মহাকাশে নিয়ে যাওয়া যায়, ওদেরকে পৃথিবীর চারিদিকে ভ্রমণ করানো যায়, কিভাবে অন্য দেশের কৃত্রিম উপগ্রহ বা মিসাইলকে রোবোট হাতিয়ার দিয়ে ধ্বংস করে দেয়া যায়, ইত্যাদি। অ্যাপোলো ঐ সকল পরিকল্পনাকে প্রতিস্থাপিত করে দিয়েছিলো, ওগুলো আর কখনো আলোর মুখ দেখেনি। অ্যাপোলো প্রোগ্রামকে এই একটা কারণে সাধুবাদ জানানো যায়—আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ প্রতিযোগিতাকে সামরিক থেকে নাগরিক ক্ষেত্রে নিয়ে আসার জন্য। কেউ কেউ মনে করেন, মহাকাশে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা কমানোর জন্যেই কেনেডি অ্যাপোলো প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছিলেন। হয়তো!
অ্যাপোলো ১১-এর মত আরো ছয়টা অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিলো। একটা ছাড়া বাকি সবগুলোই সফলভাবে চাঁদে অবতরণ করেছিলো। অ্যাপোলো ১৭-তে প্রথমবারের মত একজন বিজ্ঞানী চাঁদে গিয়েছিলেন। এবং এরপরেই অ্যাপোলো প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে গিয়েছিলো। চাঁদে অবতরণ করা শেষ মানুষটা ছিলেন প্রথম বিজ্ঞানী। প্রোগ্রামের উদ্দেশ্যটা ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ের সেই রাতেই সফল হয়ে গিয়েছিলো। পরের ছয়টা অভিযান শুধু সেই উৎসাহের তোড়েই আয়োজন করা হয়েছিলো।
অ্যাপোলোর মূল উদ্দেশ্য বিজ্ঞান ছিলো না। আসলে, মহাকাশও অ্যাপোলোর মূল উদ্দেশ্য ছিলো না। অ্যাপোলোর মূল ভিত্তি ছিলো মতাদর্শিক সংঘর্ষ আর পারমাণবিক যুদ্ধ; অবশ্য প্রচার করার সময় এগুলোকে “নেতৃত্ব” আর “জাতীয় সম্মান/অহংকার” এর মত লঘু শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়। যে উদ্দেশ্যেই হোক, মহাকাশ নিয়ে ভালো গবেষণা কিন্তু হয়েছিলো। এখন আমরা চাঁদের গঠন, বয়স, ইতিহাস, ভূ-পৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি জানি। চাঁদ কোত্থেকে এসেছে, সেটা আগের চেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছি। প্রাণের উৎপত্তির সময়ে পৃথিবী কেমন ছিলো, সেটা জানার জন্য অনেকে চাঁদের গর্তগুলো গবেষণা করেছেন। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার হচ্ছে, অ্যাপোলো একটা ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে, যার ছায়াতলে সুনিপুণভাবে তৈরি করা রোবোটিক মহাকাশযানগুলো ছড়িয়ে পড়েছে সৌরজগতের সবদিকে, কয়েক ডজন নতুন জগতের প্রাথমিক জরিপ সম্পন্ন করেছে। অ্যাপোলোর সন্তানগুলো এখন গ্রহের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দূর-দূরান্তে।
অ্যাপোলো না থাকলে (অথবা ঐ বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকলে), সৌরজগতের সকল প্রান্তে ঐতিহাসিক আমেরিকান অভিযানগুলো পরিচালিত হতো বলে আমার মনে হয় না। ম্যারিনারস, ভাইকিংস, ভয়েজারস, ম্যাজেলান, গ্যালিলিও, ক্যাসিনি—এরা সবাই অ্যাপোলোর উপহার। একই কথা সোভিয়েতদের সৌরজগত অভিযানগুলোর ক্ষেত্রেও খাটে, যেমন—লুনা ৯, মার্স ৩, ভেনেরা ৮, ইত্যাদি।
অ্যাপোলোর হাজির করা আত্মবিশ্বাস, শক্তি, উৎসাহ, আর দূরদৃষ্টি ঠিকই গোটা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। এমনকি যারা আমেরিকার শুভাকাঙ্ক্ষী না, তারাও স্বীকার করে যে, অ্যাপোলোর পাশাপাশি আমেরিকাও গৌরব অর্জন করেছে, কারণ বা উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন। পাশাপাশি, এটা প্রযুক্তির ব্যাপারে আমাদেরকে আরো আশাবাদী করে তুলেছিলো, ভবিষ্যতের ব্যাপারে আরো উৎসাহী করে তুলেছিলো। ভাবটা এমন—চাঁদে যেহেতু যেতে পেরেছি, তাহলে আরো অনেক কিছু নিশ্চয়ই সম্ভব!
যখন দূরের কোথাও ভ্রমণের জন্য ব্যাগ গুছান, তখন কিন্তু আপনি জানেন না যে যাওয়ার পর আসলে কী কী ঘটবে। অ্যাপোলোর নভোচারীরা চাঁদে যাওয়া আর আসার পথে তাদের নিজ গ্রহের ছবি তুলেছিলো। তোলাটাই স্বাভাবিক! কিন্তু এই ছবিটার প্রভাব যে কী হতে পারে, সেটা কল্পনা করতে পারেনি অনেকেই। প্রথমবারের মত পৃথিবীবাসী নিজেদের বসতটাকে ওপর থেকে দেখলো—গোটা পৃথিবী, রঙিন, অন্ধকার মহাশূন্যের ক্যানভাসে ঘূর্ণনরত নীল আর সাদা একটা বল। ঘুমিয়ে থাকা একটা জাতি যেন জেগে উঠলো, সচেতন হলো নিজেদের গ্রহের ব্যাপারে। ছবিগুলো যেন চিৎকার করে সবাইকে বলছিলো, আমরা সবাই একই ছোট্টো ঠুনকো পৃথিবীর বাসিন্দা। ছবিগুলো বুঝিয়ে দিলো, কোনটা জরুরি, আর কোনটা জরুরি না।
আমরা হয়তো একদম সঠিক সময়ে এই অনুভূতিটা অনুধাবন করতে পেরেছি, ঠিক যখন আমাদের তৈরি করা প্রযুক্তি আমাদেরই বিশ্বটাকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলার হুমকি দিচ্ছে। অ্যাপোলো প্রোগ্রাম হাতে নেয়ার পেছনে কারণ যেটাই হোক, স্নায়ুযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা দিয়ে প্রোগ্রামটা যতই কলুষিত হোক না কেন, হত্যার হাতিয়ারের সাথে এটার যতই সম্পর্ক থাকুক না কেন, পৃথিবীর অখণ্ডতা, নিঃসঙ্গতা, আর ভঙ্গুরতার ব্যাপারে এটা সবাইকে একজোট করেছে—আর এটাই অ্যাপোলোর শেষ অপ্রত্যাশিত উপহার। ভয়ংকর প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেটা শুরু হয়েছিলো, সেটাই আমাদেরকে দেখালো যে টিকে থাকতে হলে বিশ্বের সবাইকে অবশ্যই একজোট হতে হবে।
ভ্রমণের ক্ষেত্র বাড়ছে। যাত্রা শুরু করার এখনই সময়!
– কার্ল সেগান (১৯৩৪-১৯৯৬)
প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সভাপতি, দ্যা প্ল্যানেটারি সোসাইটি
অধ্যাপক, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়
—নাজমুল হাসান