আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক বিষ্ময়কর প্রতিভার নাম মাইকেল ফ্যারাডে । তিনি ছিলেন একাধারে পদার্থবিদ , রসায়নবিদ ও তড়িত প্রকৌশলী। আজ থেকে প্রায় দু’শ বছর আগে তার আবিষ্কৃত ‘আলোকের উপর চৌম্বকের প্রভাব’ আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে এনে দিয়েছিল বিরাট পরিবর্তন। ১৭৯১ সালে ইংল্যান্ডের নিউইংটন বাটসে জন্মগ্রহন করেন মাইকেল ফ্যারাডে।
“ আমরা যদি ফ্যারাডের আবিষ্কারের বিশালতা ও ব্যাপ্তি কল্পনা করি, এবং সেই সাথে বিজ্ঞান ও শিল্পের উপর তাঁর প্রভাব লক্ষ্য করি, তাহলে দেখা যাবে যে তাঁকে দেওয়ার মতো বড় মাপের কোনো সম্মাননা খুঁজে পাওয়াই ভার, সর্বকালের সেরা আবিষ্কর্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন এক সত্তা।""
— পদার্থবিজ্ঞানী স্যার আর্নেস্ট রাদারফোর্ড
জন্ম এবং শৈশবঃ-
১৭৯১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের নিউইংটন বাটস অঞ্চলে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে। কামার পিতা এবং গৃহিণী মায়ের চার সন্তানের সংসারে ফ্যারাডের অবস্থান তৃতীয়। জন্মের পর থেকেই অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয় ফ্যারাডের। প্রায়ই তাকে অনাহারে দিন পার করতে হতো। তার পিতা শারীরিকভাবে মারাত্মক অসুস্থ ছিলেন। দিনের পুরোটা সময়ই তার মেজাজ থাকত তিরিক্ষি। কিন্তু ফ্যারাডের মা সবসময় তাকে সঙ্গ দিতেন। মাঝে মাঝে সামান্য একটি রুটি দিয়ে পুরো সপ্তাহ পার করতে হতো ফ্যারাডের।
স্কুলজীবনঃ-
একটু বড় হওয়ার পর ফ্যারাডেকে স্কুলে ভর্তি করা হয়। কিন্তু পড়াশোনায় তিনি দুর্বল ছিলেন। এমনকি তিনি সঠিকভাবে ইংরেজি ‘আর’ উচ্চারণ করতে পারতেন না। তাকে নিয়ে স্কুলে বন্ধুরা প্রায়ই হাসি-তামাশা করত। তবু মায়ের উৎসাহে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেননি ফ্যারাডে।
মায়ের স্বপ্ন তার ছেলে শিক্ষিত হয়ে পরিবারের অভাব দূর করবে। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হল না। ফ্যারাডের বয়স তখন ১৩। দারিদ্র্যের কষাঘাতে বন্ধ হল পড়াশোনা। চাকরি খুঁজতে হবে ফ্যারাডেকেও। ময়লা একটা জামা পরে রওনা দেন কাজের সন্ধানে। খুব দ্রুত তার চাকরি হয়ে যায় স্থানীয় এক বইয়ের দোকানে।
তবু বই হল সঙ্গীঃ-
প্রথমদিকে ফ্যারাডে বুক ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করতেন। তার কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে মালিক তাকে বুক বাইন্ডারের পদে উন্নীত করেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পুরনো বই নেড়েচেড়ে দেখতেন তিনি। একদিন তার কাছে বেশ বড় বড় কিছু বই বাঁধাইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেগুলো ছিল ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’র তৃতীয় সংস্করণ। ফ্যারাডে একটি বই হাতে নিয়ে মাঝখান থেকে পড়া শুরু করলেন। এ বই পড়েই তিনি বিদ্যুৎ সম্পর্কে জানতে পারেন। হাতের কাছে যা পেতেন তা দিয়েই বিভিন্ন পরীক্ষা করতেন। ফ্যারাডের বিজ্ঞানী হওয়ার চেষ্টা শুরু এখান থেকেই।
তার নতুন কর্মস্থলঃ-
১৮১৩ সালের ১ মার্চ ফ্যারাডে রয়্যাল ইন্সটিটিউটের গবেষণাগারে যোগ দেন। অবাক চোখে ফ্যারাডে গবেষণাগারের সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি ধরে দেখতে লাগলেন। নতুন কিছু জানার নেশায় তার চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল। নতুন কর্মস্থলে ফ্যারাডের বেতন ছিল আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ফ্যারাডের জীবন থেকে দারিদ্র্যের অভিশাপ দূর হল। ডেভির সঙ্গে হাতে-কলমে কাজ শিখতে লাগলেন ফ্যারাডে। সারা দিন ব্যয় করতেন গবেষণাগারের কাজে। তিনি একবার দুর্ঘটনায় পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তারপরও দমে যাননি।
এবং বিয়েঃ-
পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন দুই বিষয়ে সমান আগ্রহী এবং পণ্ডিত ছিলেন মাইকেল ফ্যারাডে। কিন্তু তার বিজ্ঞানী হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ হয় রসায়নবিদ হিসেবে।
১৮২০ সালে তিনি কার্বন এবং ক্লোরিনের সমন্বয়ে গঠিত যৌগ তৈরি করেন। এর মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানীমহলে নিজের আগমনের জানান দেন।
বিজ্ঞানী হিসেবে চারদিকে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। পরের বছর তিনি সারাহ বার্নাড নামের এক নারীর প্রেমে পড়েন। ওই বছরই তারা বিয়ে করেন এবং রয়্যাল ইন্সটিটিউটে স্থায়ীভাবে বসবাস করা
শুরু করেন।
বৈদ্যুতিক মোটর আবিষ্কার:-
বিজ্ঞানী হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান ওয়েরস্টেডের মতে বিদ্যুতায়িত তারের আশপাশে চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ, বিদ্যুতায়িত তার চুম্বকের মতো আচরণ করে। মাইকেল ফ্যারাডে এ তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে সর্বপ্রথম বৈদ্যুতিক মোটর আবিষ্কার করেন। ১৮২৩ সালে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ক্লোরিন এবং অ্যামোনিয়া গ্যাস তরলে রূপান্তর করতে সক্ষম হন তিনি। ১৮৬২ সালে ফার্দিনান্দ ক্যারে নামের এক বিজ্ঞানী এর সাহায্যে পৃথিবীর সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক বরফকল তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য বিজ্ঞানীর গবেষণার মাধ্যমে আরও কয়েক ধাপ সংস্করণের মাধ্যমে তা রেফ্রিজারেটর হিসেবে আমাদের আবাসস্থলে জায়গা করে নিয়েছে। এর আগে বিভিন্ন ধরনের রেফ্রিজারেটর আবিষ্কৃত হলেও তা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের উপযোগী ছিল না।
বিদ্যুৎ ও চুম্বকঃ-
ফ্যারাডে একদিন একটি কুণ্ডলাকৃতির তারের সঙ্গে ব্যাটারির সংযোগ দিলেন। পুরো বর্তনীর সঙ্গে একটি গ্যালভানোমিটার যুক্ত করে দিলেন। এরপর কুণ্ডলীর ভেতর একটি চুম্বক প্রবেশ করান। সঙ্গে সঙ্গে গ্যালভানোমিটারের কাঁটা কেঁপে ওঠে। তিনি ফের চুম্বকটি বাইরে বের করে আনার সময় কাঁটা বিপরীত দিকে কেঁপে উঠল। তিনি বিস্মিত হয়ে গেলেন। তিনি এ ধর্মের নাম দিলেন তড়িৎ চুম্বকীয় আবেশ। কিন্তু ফ্যারাডে তখনও সন্তুষ্ট ছিলেন না।
তিনি এ ধর্মকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু প্রথমদিকে বারবার ব্যর্থ হতে থাকেন। তবু হার মানলেন না। রাত-দিন এর পেছনে সময় দিতে থাকেন। একদিন হঠাৎ তার মাথায় একটি বুদ্ধি এলো। তিনি তামার তৈরি চাকতি দিয়ে একটি অদ্ভুত যন্ত্র তৈরি করলেন। এরপর চাকতিটি অবিরাম ঘোরানোর পর সেই যন্ত্রের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হল। আনন্দে ফ্যারাডে লাফিয়ে উঠলেন। তিনি নতুন বিপ্লবের জন্ম দিলেন। আর সেই বিপ্লবের নাম ‘ডায়নামো’। এর কল্যাণে আজ আমরা সর্বত্র বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারছি।
তার মৃত্যুঃ-
১৮৫৫ সালে মাইকেল ফ্যারাডে শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর আর কখনও গবেষণাগারে কাজ করতে পারেননি। দীর্ঘ একযুগ শয্যাশায়ী থাকেন। ১৮৬৭ সালের ২৫ আগস্ট তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তিনি কোনো সন্তান রেখে যেতে পারেননি। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে লন্ডনের হাইগেটে সমাধিস্থ করা হয়।
মাইকেল ফ্যারাডের কয়েকটি উক্তিঃ-
* কোনো কিছুই সত্যিকারের সুন্দর নয়, যদি তা প্রকৃতি প্রদত্ত না হয়।
* সাফল্যের জন্য উদ্যোক্তার পাঁচটি প্রয়োজনীয় দক্ষতা হচ্ছে- সংযোগ, বাছাই, সংগঠন, নতুনত্ব এবং যোগাযোগ।
* কিছু পেতে হলে যতক্ষণ সম্ভব চেষ্টা করে যাও।
* স্রষ্টার হাতে লেখা প্রকৃতির বই আমাদের পড়তে হবে।
* যে কেউ নিজেকে যত বড় দার্শনিকই ভাবেন না কেন, তার তত্ত্বে কোনো না কোনো সন্দেহ থেকেই যায়।
* কেউ যদি নিজেকে কোনো বিষয়ে সঠিক মনে করেন, তাকে সম্পূর্ণ ভুল মনে করার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।
* আমি বিশ্বাস করি প্রতিটি উত্তরের পেছনে একটি করে প্রশ্ন তৈরি হতে থাকে।
Read this article in English - Scientist sir Michael Faraday